Tuesday, August 14, 2012

১৫ ই অগাস্ট ১৯৭৫ শুক্রবার

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল তোমার। বাহিরে গোলা গুলি হচ্ছে ....... কিন্তু কেন?দেশ তো এখন স্বাধীন।এখন সবার একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ এর জন্য কাজ করার কথা। আবার গোলা গুলির শব্দ আসছে। এবার আগের থেকে আরও জোরালো, মনে হচ্ছে বাড়ির ভেতর থেকে আসছে।তুমি বিছানা থেকে নামলে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসলে দোতালার বারান্দাতে।গোলা গুলির শব্দ একটু কমলো মনে হচ্ছে তবে থেমে যাইনি এখন।কি হচ্ছে সেটা পরিষ্কা র বুঝা যাচ্ছে না।খাঁচায় বন্দী বাঘ এর মতো তুমি দোতালার বারান্দা আর বেলকনীতে পায়চারি করছো । টেলিফোন এর রিসিভার টা তুলে গণভবন এর নাম্বার এ ফোন করলে .... কিন্তু লাইন পাওয়া যাচ্ছে না।৩/৪ বার চেষ্টা করে অবশেষে লাইন পাওয়া গেল।কর্নেল জামিল কে বললে জামিল আমি বিপদে পরেছি,কে বা কারা হামলা করেছে জানি না তুমি দ্রুত আমার এখানে আস। এবার গোলা গুলির শব্দ টা নিচ তলা থেকে আসছে মনে হচ্ছে।তুমি আবার ছুটে আসলে দোতালার বারান্দা তে, নিচে তাকিয়ে দেখলে .... দুইজন অস্ত্রধারী সৈনিক তোমার দিকেই তাকিয়ে আছে।তুমি হুঙ্কার দিয়ে উঠলে অ্যাই তোরা কি চাস ?তোমার হুঙ্কার শুনে চমকে উঠলো দুইজন।তুমি এগিয়ে গেলে নীচতলায় নামার সিঁড়ীর দিকে।তখনো দুইজন তোমার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি ।তবে নিঃশব্দে কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সিঁড়ির গোঁড়া তে । ফজর এর আযান হচ্ছে .. সেই দুইজন সৈনিক এখনো তোমার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি ।আযান এর এই সুমধুর সুরটা আজ কেন যেন অন্যরকম লাগছে ।জামীল এর এখনো দেখা নেই ...... তুমি আবার জীগেষ্ণ করলে অ্যাই তোরা কি চাস ? এবার ও কোনও উত্তর পাওয়া গেল না ......... তবে এবার তোমার প্রশ্ন শুনে একজন অপর জন এর দিকে তাকাতে অন্যজন উপর নিচ মাথা নরিয়ে কী যেন ঈশারা করলো । তুমি তখন ঠিক সিঁড়ির মাঝ বরাবর নিচে তাকিয়ে দেখলে বীভৎস কালো ম্যাসিন গান এর নল টা তোমার বুক বরাবর ..... তীক্ষ্ণ তীব্র একটা জ্বালা তে তোমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো .... পরনের সাদা পাঞ্জাবী টা লাল হয়ে যাচ্ছে ... তুমি অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি দিয়ে ক্ষণিক এর জন্য তোমার দুই হত্যাকারী সৈনিক কে দেখলে তারপর ঢলে পড়লে সিঁড়ীর উপর ..... তীব্র ব্যা থা য় নীল হয়ে গেছে তোমার পুরো শরীর ..... সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে ফিনকী দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তোমার ঘন লাল রক্ত ।এখনো আযান এর সুর শোনা যাচ্ছে .... তারপর জমাট বাঁধা অন্ধকার । দূর থেকে তোমার নিথর শরীরটার দিকে তখনো ভয় ভরা চোখ এ তাকিয়ে আছে অস্ত্রধারী দুই সৈনিক, যেন ভয় করছে তুমি আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠবে ....প্রথমে তোমার হুঙ্কার শুনে সেদিন কেপে উঠেছিল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর এর পুরো বাড়ী। তোমার সেই হুঙ্কার শুনে কেপে উঠেছিল তোমাকে হত্যা করতে আসা সৈনিক এর হৃদয়।তারা জানত তুমি মৃত্যু কে ভয় করনা।তুমি ভয় করনা রক্তের ঘন লাল রং কে।বরং তুমি ভয়ংকর ভালোবাসো এই ঘন লাল রং এর সাথে মিশ্রিত সবুজ রং এর একটি পতাকা কে।১৯৭১ এর ৭ই মার্চ এ ওরা তোমার সেই রক্ত পাগল করা ভাষণ শুনেছিল।ওরা জানত তুমি কথা বলা শুরু করলে আর সবাই নীরব থাকত।তাই ওরা তোমাকে আর অবকাশ দেয়নি কোনও কথা বলার। তবে ওদের সৌভাগ্য যে আমরা বর্তমান প্রজন্ম তখন নেহাতই শিশু ছিলাম।ঠিক রাসেল এর মত নিষ্পাপ।রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ,রক্তের ঘন লাল রং,দেশ,পতাকা সর্বোপরি মানচিত্র এসব কিছু রাসেল এর মতো আমরাও বুঝতাম না।যদি বুঝতাম তাহলে আজ ইতিহাস লিখা হতো ভিন্ন ভাবে।ওদের সৌভাগ্য কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য।আমি নিশ্চিত তোমাকে হত্যা করতে আসা প্রতিটি সৈনিক জানত তুমি একটি ভয়ংকর সাহসী মানুষ।এতটাই সাহসী যে পাকিস্তানী বর বর জাঁদরেল আর্মি অফিসার ও তোমার সামনে কথার খেই হারিয়ে ফেলত। আবার তুমি এতটাই আবেগি ছিলে যে পাকিস্তানী কারাগার হতে মুক্ত হোয়ে দেশ এর খবর জানার পর কান্নায় দু চোখ ভাসিয়ে দিয়েছ।১৯৭২ এ তুমি যখন দেশ এ ফের তারও ৪ বসর পর আমি জন্ম গ্রহন করেছি,কিন্তু আজ এই ২০১২ সন এ এসেও যখন তোমার ৭ই মার্চ এর সেই বজ্র কণ্ঠ স্বর শুনি বিশ্বাস কর আমার শরীর এর প্রতিটি রক্ত কনা টগবগ করে ফুট তে শুরু করে।শরীর যেন আপনা থেকেই বিদ্রোহী হয়ে যুদ্ধে যেতে চায়। বঙ্গবন্ধু আজ তোমার মতো একজন মানুষ আমাদের ভীষণ দরকার ।আমরা নেতৃত্ব বিহীন একটি জাতি আজ তোমার মৃত্যুর ৩৭ বসর পরও প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ক্ষণ এ তোমার মত আর একজন শেখ মূজীব কে পাগল এর মতো খুঁজে ফিরছি ......

No comments:

Post a Comment